প্লাস্টিডের গঠন ও কাজ

 প্লাস্টিডের গঠন ও কাজ

                                 

গ্রিক শব্দ Plastikas থেকে Plastid (প্লাস্টিড) শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। প্লাস্টিডই হচ্ছে উদ্ভিদ দেহের সর্ববৃহৎ ক্ষুদ্রাঙ্গ বা অঙ্গাণুযে বড় সাইটোপ্লাজমিক অঙ্গানুটি পিগমেন্ট (রঞ্জক পদার্থ) ধারণ করে বা খাদ্য সঞ্চয় করে রাখে তাকে প্লাস্টিড বলেপ্লাস্টিডের উপস্থিতি স্বভোজী জীবের (উদ্ভিদ দেহের) কোষের অনন্য বৈশিষ্ট্য। 

১৮৮৩ সালে শিম্পার সর্বপ্রথম উদ্ভিদকোষে সবুজ বর্ণের প্লাস্টিড আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে অন্যান্য প্লাস্টিড আবিষ্কৃত হয়েছে। (কিছু স্বভোজী জীবে, যেমন- নীলাভ সবুজ শৈবাল, ফটোসিনথেটিক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদিতে ক্রোমাটোফোর নামক বিশেষ গঠন থাকে, এতে সালোকসংশ্লেষণকারী রঞ্জক থাকে)। ভাজক টিস্যুর অপরিণত প্লাস্টিডকে ‘প্রো-প্লাস্টিড’ বলে। 

 

প্লাস্টিডের শ্রেণিবিন্যাসঃ প্লাস্টিড প্রধাণত ৩ প্রকারঃ যথ্যাঃ-

১. লিউকোপ্লাস্টঃ এগুলো বর্ণহীন । তবে আলোর সংস্পর্শে এরা অন্যন্য বর্ণধগারন করতে পারে। বিশেষ করে উদ্ভিদে ক্লোরোফিল কমে গেলে সূর্যালোকের সংস্পর্শে এরা ক্লোরোপ্লাস্টে পরিণত হয়। 

সঞ্চিত খাদ্যের উপর ভিক্তি করে লিউকোপ্লাস্টকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-

ক) এমাইলোপ্লাস্টঃ শর্করা বা স্টার্চ ধারনকারী লিউকোপ্লাস্টগুলোকে এমাইলোপ্লাস্ট বলে। 

খ) ইলায়োপ্লাস্টঃ লিপিড বা চর্বিজাতীয় খাদ্য সঞ্চয়কারী লিউকোপ্লাস্টগুলোকে ইলায়োপ্লাট বলে। 

গ) এলিউরোপ্লাস্টঃ প্রোটিনজাতীয় খাদ্য সঞ্চয়কারী লিউকোপ্লাস্টগুলোকে এলিউরোপ্লাস্ট বলে। 
২. ক্রোমোপ্লাস্টঃ সবুজ ব্যতিত যেকোন রঙ্গিন বর্ণধারনকারী প্লাস্টিডগুলোকে ক্রোমোপ্লাস্ট বলে। যেমন কমলা বর্ণের ক্যারোটিন, হলুদ বর্নের জ্যান্থফিল। এরা রঙ্গিন ফুল ফল বীজ, মুল(গাজরশালগম) ইত্যাদি জায়গায় থাকতে পারে। 

৩. ক্রোরোপ্লাস্টঃ সবুজ বর্ণের প্লাস্টিডগুলোকে ক্রোরোপ্লাস্ট বলা হয়। ক্লোরোপ্লাস্ট উদ্ভিদের সবুজ অংশ বিশেষ করে পাতায় থাকে। এদের জন্যই উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষন করতে পারে।

ক্লোরোপ্লাস্ট কী?

সবুজ বর্ণের প্লাস্টিডকে বলা হয় ক্লোরোপ্লাস্ট (chloroplast)ক্লোরোফিল -a, ক্লোরোফিল -b, ক্যারোটিন ও জ্যান্থোফিলের সমন্বয়ে ক্লোরোপ্লাস্ট গঠিত। ক্লোরোফিল নামক সবুজ বর্ণকনিকা (pigment) অধিক মাত্রায় ধারণ করে বলে এরা সবুজ বর্ণের। 

এতে অন্যান্য বর্ণকণিকাও কিছু কিছু পরিমাণে বিদ্যামান থাকে। উদ্ভিদের জন্য ক্লোরোপ্লাস্ট অতীব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু। ১৮৮৩ সালে বিজ্ঞানী শিম্পার সর্বপ্রথম উদ্ভিদ কোষে সবুজ বর্ণের প্লাস্টিড লক্ষ করেন এবং নামকরণ করেন ক্লোরোপ্লাস্ট। ক্লোরোপ্লাস্ট খাদ্য সংশ্লেষে সাহায্যে করে বলে কোষের রান্নাঘর” বা  ‘শর্করা জাতীয় খাদ্যের কারখানা’ বলে। এটি শক্তির রুপান্তর অঙ্গানু। 

 

প্রতি কোষে সংখ্যা: এক হতে একাধিক। উচ্চশ্রেণির উদ্ভিদকোষে সাধারণত ১০ হতে ৪০ টি ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে। কিন্তু নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদকোষে সাধারনত আরও কম থাকে।

আকৃতি: উচ্চশ্রেনির উদ্ভিদকোষে ক্লোরোপ্লাস্টের আকৃতি সাধারনত লেন্সের মতো হয়ে থাকে। নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদে এদের আকৃতি হরেক রকম হতে পারে, যেমন- পেয়ালাকৃতি, সর্পিলাকার, জালিকাকার, তারকাকার, ফিতা বা আংটি আকৃতির, গোলাকার ইত্যাদি। শৈবালে ক্লোরোপ্লাস্টের বৈচিত্র বেশি।

আকার: লেন্স আকৃতির ক্লোরোপ্লাস্টের ব্যাস সাধারণত ৩-৫ মাইক্রন। স্প্রাইরোগাইরা এর সর্পিলাকার ক্লোরোপ্লাস্ট সোজা অবস্থায় কোষের দৈর্ঘ্যের চেয়েও বেশি লম্বা।

উৎপত্তি: নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদে পুরাতন ক্লোরোপ্লাস্টের বিভাজনের মাধ্যমে নতুন ক্লোরােপ্লাস্টের উৎপত্তি হয়। উচ্চ শ্রেণির উদ্ভিদে আদি প্রাস্টিড হতে এদের উৎপত্তি হয়। আদি প্রাস্টিড ০.৫ মাইক্রন ব্যাসবিশিষ্ট একটি গােলাকার বস্তু। প্রতিটি আদি প্লাস্টিডে ঘন স্টোমা (ধাত্র পদার্থ) একটি দ্বিস্তরবিশিষ্ট আবরণী দ্বারা আবৃত থাকে। সূর্যালােকের উপস্থিতিতে ক্লোরােফিল সৃষ্টির সাথে সাথে আদি প্রাস্টিড পূর্ণাঙ্গ ক্লোরােপ্লস্টে পরিণত হতে থাকে। 

আদি প্রাস্টিডের দ্বিস্তরবিশিষ্ট আবরণীর ভেতরের স্তর হতে ফোস্কা (vesicles) বের হয়ে আসে এবং ধাত্র পদার্থে সমান্তরালভাবে সজ্জিত হয়। এ ফোস্কাগুলাে মিলিত হয়ে একটি ল্যামেলাম তৈরি করে। কিছু কিছু স্থানে একাধিক ল্যামেলি গ্রানাম তৈরি করে কিছু কিছু ল্যামেলি বিভিন্ন গ্রানার মধ্যে সংযােগ রক্ষা করে। 

এভাবে আদি প্লাস্টিড হতে সূর্যালােকের উপস্থিতিতে নতুন ক্লোরােপ্লাস্টের সৃষ্টি হয়। কিছুদিন সূর্যালােক পেলে ক্লোরােপ্লাস্ট লিউকোপ্লাস্টে পরিণত হয়, তাই সবুজ অংশ বর্ণহীন হয় 

 

ক্লোরােপ্লাস্টের গঠন



একটি পরিণত ক্লোরােপ্লাস্ট নিম্নলিখিত অংশগুলাে নিয়ে গঠিত।

১. আবরণী ঝিল্লি : সমস্ত ক্লোরােপ্লাস্ট একটি দুই স্তরবিশিষ্ট আংশিক অনুপ্রবেশ্য (semipermeable) মেমব্রেন (ঝিল্লি) দ্বারা আবৃত থাকে। ক্লোরােপ্লাস্ট মেমব্রেনে ফসফোলিপিড-এর পরিবর্তে গ্রাইকোসিল গ্লিসারাইড (glycosyl glyceride) থাকে। এটি একটি ব্যতিক্রমী গঠন।

২. স্ট্রোমা : আবরণী ঝিল্লি দ্বারা আবৃত পানিগ্রাহী, কলয়েডধর্মী ম্যাট্রিক্স তরলকে স্ট্রোমা (stroma) বলে। স্ট্রোমাতে 70s রাইবােসােম, অসমােফিলিক দানা, DNA, RNA, ইত্যাদি থাকে। এতে শর্করা তৈরির এনজাইমও থাকে। সালােকসংশ্লেষণে কার্বন বিজারণের মাধ্যমে শর্করা উৎপাদন প্রক্রিয়া (C3 বা C4 চক্র) স্ট্রোমাতে ঘটে থাকে।



৩. থাইলাকয়েড ও গ্রানাম : স্ট্রোমাতে অসংখ্য থলে আকৃতির 100-300 A প্রস্থ বিশিষ্ট ত্রিমাত্রিক সজ্জার গঠন বিদ্যমান। এদের থাইলাকয়েড (thylacoid) বলে। প্রত্যেকটি থাইলাকয়েডের ভেতরে একটি প্রকোষ্ঠ থাকে। এ প্রকোষ্ঠে থাকে ক্লোরােফিল-a, ক্লোরােফিল-b, জ্যান্থোফিল, ক্যারােটিন, লিপিড় ও এনজাইম। এসব বস্তুকে একত্রে স্ফটিকাকার দানার মতাে দেখায়। 

তখন এদের কোয়ান্টোসােম বলে। কতগুলাে থাইলাকয়েড় একসাথে একটির ওপর আর একটি সজ্জিত হয়ে শুপের মতাে থাকে। থাইলাকয়েডের এ স্থূপকে গ্রানাম। (granum, বহুবচনে গ্রানা) বলা হয়। ১০ থেকে ১০০টি থাইলাকয়েড উপর্যুপরি । সজ্জিত হয়ে একটি গ্রানাম গঠন করে। প্রতিটি ক্লোরােপ্লাস্টে সাধারণত ৪০-৬০টি গ্রানা থাকে। একটি গ্রামের আকার ০.৩-১.৭ m (মাইক্রোমিটার)। গ্রানাম | চক্রের ঝিল্লির ভেতরের গায়ে কোয়ান্টোসােম নামক কিছু স্ফটিকার বস্তু থাকে।

৪. স্ট্রোমা ল্যামেলি : দুটি পাশাপাশি গ্রানার কিছু সংখ্যক থাইলাকয়েডস সূক্ষ্ম নালিকা দ্বারা সংযুক্ত থাকে। এই সংযুক্তকারী নালিকাকে স্ট্রোমা ল্যামেলি (একবচনে-ল্যামেলাম) বলে। এদের অভ্যন্তরেও কিছু পরিমাণ ক্লোরােফিল বিদ্যমান থাকে।

৫. ফটোসিনথেটিক ইউনিট ও ATP-synthases : থাইলাকয়েড মেমব্রেন বহু গােলাকার বস্তু বহন করে। ইলাকয়েড মেমব্রেনের ভেতরের গাত্রে অসংখ্য সালােকসংশ্লেষণকারী একক ও ATP সিন্থেসেস নামক বস্তু থাকে।

ATP - সিন্থেসেস নামক বস্তুতে ATP-তৈরির সকল এনজাইম থাকে। মেমব্রেনগুলােতে অসংখ্য ফটোসিনথেটিক ইউনিট থাকে। প্রতি ইউনিটে ক্লোরােফিল-এ, ক্লোরােফিল-বি, ক্যারােটিন, জ্যান্থোফিল এর প্রায় ৩০০-৪০০টি অণু থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের এনজাইম, মেটাল আয়ন, ফসফোলিপিড, কুইনােন, সালফোলিপিড ইত্যাদি থাকে।

৬. DNA ও রাইবােসােম : একটি ক্লোরােপ্লাস্টের মধ্যে সমান আকৃতির প্রায় ২০০টি DNA অণু থাকতে পারে। ক্লোরােপ্লাস্টে তার নিজস্ব বৃত্তাকার DNA ও রাইবােসােম থাকে। এদের সাহায্যে ক্লোরােপ্লাস্ট নিজের অনুরূপ সৃষ্টি (reproduce) ও কিছু প্রয়ােজনীয় প্রােটিন তৈরি বা সংশ্লেষ করতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারণা কোনাে আদিকোষীয় DNA ও রাইবােসােম এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 




রাসায়নিক গঠন : রাসায়নিকভাবে ক্লোরােপ্লাস্ট প্রধানত কার্বোহাইড্রেট, লিপিড, প্রােটিন নিয়ে গঠিত। এছাড়া এতে থাকে ক্লোরােফিলী প্রােটিনের মধ্যে ৮০% হচ্ছে অদ্রবণীয় যা লিপিডের সঙ্গে একত্রে ঝিল্লি নির্মাণ করে, বাকি ২০% দ্রবণীয় এবং এনজাইম হিসেবে থাকে। ক্লোরােপ্লাস্টের রয়েছে ক্লোরােফিল নামক সবুজ বর্ণকণিকা এর ৭৫% ক্লোরােফিল-a ও ২৫% ক্লোরােফিল-b এছাড়াও রয়েছে সামান্য ক্যারােটিনয়েড ও নিউক্লিক অ্যাসিড। 

ক্লোরােপ্লাস্টের কাজ 

(i) সালােকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শর্করা জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করা ক্লোরােপ্লাস্টের প্রধান কাজ। 

(i) সৌরশক্তিকে জৈবিকশক্তিতে রূপান্তর করা এবং বায়ুর কার্বন ডাই অক্সাইডকে কোয়ান্টোসােমে সংবন্ধন করা। 

(iii) ক্লোরােপ্লাস্টের প্রয়ােজনে প্রােটিন, নিউক্লিক অ্যাসিড তৈরি করা।

(iv) ফটোফসফোরাইলেশন অর্থাৎ সূর্যালােকের সাহায্যে ADP-কে ATP-তে রূপান্তর করা । 

(v) ফটোরেসপিরেশন করা।

(vi) সাইটোপ্লাজমিক ইনহেরিটেন্সে সাহায্য করা।




Comments

Popular posts from this blog

হাতিশুঁড় গাছের উপকারিতা

মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ও কাজ

ডাবের পানির পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা ও অপকারিতা