তরমুজের পুষ্টিগুন নিয়ে নানা অজানা রহস্য


  

তরমুজ (Watermelon)

বৈজ্ঞানিক নাম : Citrullus lanatus

আমাদের দেশে অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় একটি ফল হচ্ছে তরমুজ। তরমুজ বহু পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি সুস্বাদু ও রসালো ফল। শিশু থেকে বয়ষ্ক সবাই এই ফলটি পছন্দ করেন। গ্রীষ্মের এই সময়ে রোজা রাখায় শরীরে পানিস্বল্পতা দেখা দিতে পারে। এজন্য ইফতারে রাখা যেতে পারে মৌসুমি এই ফল। এতে প্রচুর পরিমাণ জল থাকে। এই ফলে ৬% চিনি এবং ৯২% জল এবং অন্যান্য উপাদান ২%। এটি ভিটামিন এ জাতীয় ফল।

তরমুজের পুষ্টি উপাদান: 

তরমুজের প্রায় ৯২ শতাংশই পানি। ফলে এই গরমে ডিহাইড্রেশন দূর করতে তরমুজের বিকল্প নেই। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তরমুজে রয়েছে ৯২ থেকে ৯৫ গ্রাম পানি, আঁশ ০.২ গ্রাম, আমিষ ০.৫ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, ক্যালোরি ১৫ থেকে ১৬ মিলিগ্রাম। এ ছাড়াও তরমুজে ক্যালসিয়াম রয়েছে ১০ মিলিগ্রাম,আয়রন ৭.৯ মিলিগ্রাম, কার্বহাইড্রেট ৩.৫ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.২ গ্রাম, ফসফরাস ১২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ও ভিটামিন বি২। প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে। 

 তরমুজের ভিটামিন:

প্রতি ১০০ গ্রাম তরমুজের মধ্যে

ফোলেট-৩ মাইক্রোগ্রাম, নিয়াসিন- ০.১৭৮ মিলিগ্রাম, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড- ০.২২১ মিলিগ্রাম,  পাইরিডক্সিন- ০.০৪৫ মিলিগ্রাম, থায়ামিন- ০.০৩৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ- ২৮ মিলিগ্রাম,  ভিটামিন সি- ৮.১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ই- ০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ৬- ০.০৪৫ মিলিগ্রাম। 

তরমুজের স্বাস্থ্য উপকারিতা:

১. হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে:

বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে তরমুজের উপকারিতা এতটাই যে প্রতিদিন অন্তত এক টুকরো করে তরমুজ খেলে নিষ্প্রয়োনীয় ও ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলকে দূরে রাখা যায় যা হার্ট সংক্রান্ত রোগগুলিকে প্রতিরোধ করতে পারে। তরমুজে উপস্থিত সিট্রোলিন হার্টের স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই ভাল। কারণ মহিলাদের মেনোপজ হওয়ার পর যে মাঝে মাঝে ধমনী শক্ত হয়ে যায় যা ব্যাথার সৃষ্টি করে, সেটি রোধ করে করতে সাহায্য করে এই সিট্রোলিন।

২. হজম ক্ষমতা বাড়াতে:

তরমুজে রয়েছে প্রচুর পরিমানে জল যা হজম ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়া এতে রয়েছে ফাইবার যা কোষ্টকাঠিন্য দূর করে ও খাবার হজম করিয়ে পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।

৩. ওজন কমানোর জন্য:

তরমুজের সবথেকে বড় উপকারিতা হল এটি ওজন কমানোর জন্যে কার্যকরী জানা যায় কারণ তরমুজে জলের পরিমান খুবই উচ্চ। এর ফলে বিপাক ক্রিয়া সঠিক থাকে ও শরীরকে নানা ধরণের বিষক্রিয়া পদার্থ ও ফ্যাট থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে, যা ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করে।

একটি তরমুজের বড় টুকরোয় মাত্র ৮৬ ক্যালোরি , ২২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ও ১ গ্রামের থেকেও কম ফ্যাট থাকে এবং কোনোরকম কোলেস্টেরল থাকে না। এটি আপনার শরীরের প্রতিদিনের  ফাইবারের প্রয়োজনীয়তাকে ৫% মেটায় যা শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে।

৪. শরীর আর্দ্র রাখতে:

তরমুজে রয়েছে ৯০% জল যা শরীরকে বেশ আর্দ্র রাখে। তাই চা বা কফির তুলনায় তরমুজ খাওয়া অনেক বেশি উপকারী। তাই প্রস্রাবের পরিমান ঠিক থাকে ফলে কিডনিতে চাপ পড়ে না।

৫. ক্যান্সার রুখতে:

তরমুজে থাকা লাইকোপেন ক্যান্সারের প্রবণতা অনেকটা কমিয়ে আনে। এই লাইকোপেনের জন্যেই তরমুজের রং গাঢ় লাল হয় এবং এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর যা ক্যান্সার রোধ করে। দু কাপ তরমুজে রয়েছে ২০গ্রাম লাইকোপেন যা নানা ধরণের ক্যান্সারের বিরুধ্যে লড়াই করতে সাহায্য করে।  প্রস্ট্রেট ক্যান্সারের জন্যে লাইকোপেন কেমো থেরাপির মত কাজ করে যা সহজেই ক্যান্সারের কোষগুলি নষ্ট করে দেয় বলে জানা গেছে। তবে এই ব্যাপারে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

৬. মাংস পেশী ঠিক রাখতে:

ব্যায়াম বা জিম করার পর মাংস পেশীতে যখন ব্যাথা করে তখন ইলেকট্রোলাইট ও অ্যামাইনো অ্যাসিড ভরপুর সিট্রোলিন ( l-Citrulline) আরামদায়ক একটি ঔষধির কাজ করে। তরমুজে রয়েছে এই সিট্রোলিন যা মাংস পেশির ক্লান্তি দূর করতে সক্ষম বলে জানা গেছে। তাই তরমুজ খেলে শরীরে জমে যাওয়া ল্যাকটিক অ্যাসিড দূর হয় ও মাংস পেশি সচল রাখে। তাই তরমুজের উপকারিতা পাওয়ার জন্য এর রস পান করার অভ্যেস করুন।

৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:

তরমুজ ভিটামিন সি তে সমৃদ্ধ যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন বি ৬ যা অ্যান্টিবডি গঠন করতে সাহায্য করে। এর ফলে শ্বেত রক্ত ক্ষণিকা সঠিক পরিমানে তৈরী হয়। তরমুজে থাকা ভিটামিন এ শরীরকে নানা ধরণের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখে।

৮. হাঁপানির ক্ষেত্রে:

তরমুজে উপস্থিত লাইকোপেন নামক অ্যান্টি অক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ যা শরীরের নানা সমস্যা যেমন ঠান্ডা লাগা ও জ্বর প্রতিরোধ করে। এমনকি বয়স্কদের ক্ষেত্রেও তরমুজ হাঁপানির সমস্যা কম করতে পারে ।

৯. কিডনির সুরক্ষা:

যদিও তরমুজে পটাশিয়াম রয়েছে, কিন্তু অন্যান্য ফলের তুলনায় এতে পটাসিয়াম মাত্রা বেশ কম যার ফলে কিডনির সমস্যায় ভোগা মানুষদের জন্যে এটি খুবই কার্যকরী। কিডনির সমস্যা থাকলে কম পটাসিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়াই উচিত এবং এক্ষেত্রে তরমুজ অনায়াসে আপনার খাদ্য তালিকায় যোগ করতে পারেন।

১০. উচ্চ রক্তচাপ কমাতে:

তরমুজে রয়েছে উচ্চ পরিমানে সিট্রোলিন যা উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনতে দারুন কার্যকরী।

১১. চোখের জন্যে:

তরমুজ ভিটামিন এ তে পরিপূর্ণ যা চোখের জন্যে খুব প্রয়োজনীয়। ভিটামিন এ দৃষ্টি শক্তি প্রখর করে ও বয়সকালে দ্রুত ছানি পড়া রোধ করে। ফলে আপনি অনেক দিন পর্যন্ত স্পষ্ট  দৃষ্টি শক্তির অধিকারী হতে পারেন নিয়মিত তরমুজ খেলে।

১২. ডায়াবেটিসের জন্যে:

হয়তো শুনতে অবাক লাগবে যে ডায়াবেটিস কমাতে তরমুজের ভূমিকা আছে জানলে? আসলে তরমুজের শর্করার পরিমান কম থাকে এবং এছাড়া তরমুজে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান ও সঙ্গে অ্যান্টি ডায়াবেটিক উপাদানও। কিন্তু এ ব্যাপারে অবশ্যই একবার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।

১৩. গরমে স্ট্রোক আটকাতে:

শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে ও প্রচন্ড তেষ্টা মিটিয়ে তরমুজ শরীরে জলের পরিমান ঠিক রাখে। এর ফলে গরমে স্ট্রোক ( Heat stroke ) হওয়া রোধ করা সম্ভব হতে পারে।

১৪. হাড়ের স্বাস্থ্য:

হাড়ের সুস্বাস্থের জন্যে ভিটামিন সি খুব প্রয়োজনীয় কারণ এটি হাড়ের ছোট খাটো সমস্যা খুব সহজেই দূর করতে পারে । তরমুজ খাওয়ার ফলে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের চিড় ধরা রোধ করা যায়। এছাড়া হাড়ের বৃদ্ধিতেও এর প্রভাব আছে বলে জানা যায়।

১৫. মাড়ির জন্যে:

তরমুজে থাকা ভিটামিন সি মাড়ির জন্যে খুবই ভালো। ভিটামিন সি এর অভাবে মাড়ি থেকে রক্তপাত ও মাড়ির ফোলাভাব দেখা যায় যা তরমুজ নিয়মিত খেলে অনায়াসে কমতে পারে। তরমুজ এমনকি মুখের ভেতরের ব্যাকটিরিয়া ও মাড়ির সংক্রমণও রোধ করতে সাহায্য করে।

১৬. কোষ নষ্ট হওয়া আটকায়;

লাইকোপেনে সমৃদ্ধ তরমুজ শরীরের কোষগুলিকে হার্টের রোগ সংক্রান্ত ক্ষতির থেকে রক্ষা  করে।

১৭. গর্ভবতী মহিলাদের জন্যে:

গর্ভাবস্থার সময় বুকে জ্বালা ভাব হওয়া খুব সাধারণ। এছাড়া সকালে উঠে গর্ভবতী মহিলাদের অসুস্থ বোধ করতেও দেখা যায়। এই সবকিছু তরমুজ খেলে অনেকটা রোধ করা যায়। এমনকি গর্ভাবস্থার শেষের দিকে মাংস পেশিতে ব্যথা হওয়া রোধ করতে পারে এই তরমুজ।

১৮. ফোলাভাব দূর করে:

তরমুজে লাইকোপেন ছাড়াও রয়েছে আন্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান যা শরীরের সংক্রমণ ও ফোলাভাব দূর করতে সাহায্য করে।

১৯. শক্তি বাড়ায়:

তরমুজ হল ভিটামিন বি তে ভরপুর যা শরীরে শক্তি প্রদান করে বলে জানা যায়। কম  মাত্রায় ক্যালোরি থাকার ফলে এটি শরীরে যথার্থ পুষ্টি প্রদান করে শরীরে শক্তির যোগান দেয় যা আপনাকে সারাদিন তরতাজা রাখতে  সাহায্য করে। এছাড়া তরমুজে থাকা পটাশিয়াম শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের কাজ করে।

তরমুজের অপকরীতা:

যতই উপকারিতা থাকুক না কেন, যে কোনো জিনিসই অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে ক্ষতি হতে পারে, তেমনি তরমুজ খাওয়ারও সঠিক নিয়ম আছে। তরমুজ অতিরিক্ত মাত্রায় খেলে আপনার কি কি ক্ষতি হতে পারে তা নিচে দেখে নিন:

১. পেটের সমস্যা:

তরমুজে রয়েছে ভরপুর মাত্রায় লাইকোপেন যা অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে পেটের নানারকমের সমস্যা দেখা দেয় যেমন বমি, পেট খারাপ, হজমের সমস্যা, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি।

২. হাইপারক্যালেমিয়া:

হাইপারক্যালেমিয়া এমন একটি রোগ যেখানে শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক মাত্রায় পটাশিয়াম বেড়ে যায়, যা অতিরিক্ত পরিমান তরমুজ খেলে হতে পারে। এর ফলে হার্টের সমস্যা যেমন অনিয়মিত হৃদস্পন্দন ও দুর্বল নাড়ি, ইত্যাদি সমস্যা হয়।

৩. অ্যালার্জি:

যাদের তরমুজ খেলে অ্যালার্জি হয়, তাদের কোনোভাবেই তরমুজ খাওয়া উচিত না। এতে শরীরে চুলকানি, ত্বকের লালচে ভাব দেখা যায়।

তবে যাই হোক না কেন, গরমের দিনে তরমুজ খাওয়ার আরামই আলাদা। আগের সব তথ্য পড়ার পর তরমুজের স্বাস্থ্য উপকারিতা আপনি কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবেন না। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই যোগ করুন এই সুস্বাদু ও উপকারী ফলটি।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

হাতিশুঁড় গাছের উপকারিতা

মাইটোকন্ড্রিয়ার গঠন ও কাজ

ডাবের পানির পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা ও অপকারিতা